বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেকগুলো নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন শেখ হাসিনা। রাজনীতিবিদরা সাধারণ ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিতে অভ্যস্ত। ক্ষমতার বাইরে থেকে যা বলেন, ক্ষমতায় গিয়ে তা করেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা এখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি যা বলেন, তা করেন। চাপ দিয়ে, আন্দোলনের নামে সহিংসতা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে নমনীয় করা যায়নি, যায় না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেকগুলো নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন শেখ হাসিনা। রাজনীতিবিদরা সাধারণ ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিতে অভ্যস্ত। ক্ষমতার বাইরে থেকে যা বলেন, ক্ষমতায় গিয়ে তা করেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা এখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি যা বলেন, তা করেন। চাপ দিয়ে, আন্দোলনের নামে সহিংসতা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে নমনীয় করা যায়নি, যায় না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আছে। প্রথমটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। দ্বিতীয়টি তার কন্যা শেখ হাসিনার। বঙ্গবন্ধু ৯ মাস পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়ে স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। শেখ হাসিনা ফিরেছিলেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে।
বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা আটক করেছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশের ওপর সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দেয়ার পর। ওরা ভেবেছিল, বঙ্গবন্ধুকে আটক করলে, তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর অপচেষ্টা চালালে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হবে না। রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেবে বাঙালির স্বাধীন দেশের আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু তা হয়নি। বাঙালি নয়মাস অসম সাহসে লড়েছে, মরেছে, তারপরও স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশেই ফিরে এসেছিলেন ১০ জানুয়ারি। তার এই ফিরে আসা ছিল আশা ও উদ্দীপনার। লাখো শহীদের রক্তে মুক্ত স্বদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশা নিয়ে।
শেখ হাসিনাও ফিরেছিলেন এক নতুন পটভূমিতে। তিনি যখন স্বামীর সঙ্গে বিদেশে যান তখন তার পিতা জীবিত, দেশের সরকারপ্রধান। কিন্তু তিনি যখন ফিরে আসেন তখন পিতা নেই, মাতা নেই, নেই ভাই, নেই আরও কত আত্মীয়স্বজন। এক গভীর শূন্যতার মধ্যে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন নতুন এক বিরাট দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে। আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে। তার এই স্বদেশফেরা পঁচাত্তর-পরবর্তী দেশের রাজনীতির আবহ বদলে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল।
ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন, কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভানেত্রীও নির্বাচিত হয়েছেন। অত্যন্ত কাছে থেকে দেখেছেন পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন। জেল-জুলুম-অত্যাচার-মামলা উপেক্ষা করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর প্রাণপাত ধারাবাহিক সংগ্রাম। কিন্তু তিনিও রাজনীতির পিচ্ছিল পথে হাঁটবেন, সেটা হয়তো ভাবনায় সেভাবে ছিল না। অথচ তাই হলো।
১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের ঐক্য ধরে রাখার বৃহত্তর প্রয়োজনে বাধ্যতামূলক নির্বাসনে থাকা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তিনি দেশে ফিরেছিলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের লালচোখ উপেক্ষা করে। দেশে ফিরে রাজনীতিতে নতুন ইতিহাস গড়ার কারিগর হতে আত্মনিয়োগ করলেন। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তাই রাজনীতির বাইরের মানুষ তাকে বলা যাবে না। তবে রাজনীতির মঞ্চে তার আরোহণ একটু ব্যতিক্রমভাবে হয়েছে। বিশেষ অবস্থায়, বিশেষ প্রয়োজনে তিনি নৌকার হাল ধরেন।
১৯৮১ থেকে ২০২৩। ৪১ বছরের বেশি সময়ের এই পথপরিক্রমা তাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। যাত্রাপথ অবশ্যই ফুল বিছানো ছিল না। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে চলতে হচ্ছে তাকে। এখনও তিনি দল ও দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। ইতিহাস যেন তার কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে অনেক দায় ও দায়িত্ব। দায়িত্ব পালনে তিনি ক্লান্তিহীন যোদ্ধা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে রাষ্ট্রটির জন্ম দিয়েছিলেন, সেই রাষ্ট্র তার জীবন রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। নিজের পরিচর্যায় আন্তরিক দরদে গড়া দল, আওয়ামী লীগ, যে দল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, সে দলটিও মুজিব-হত্যার আকস্মিকতায় ছিল হতবিহ্বল। তারাও কোনো কার্যকর প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির সম্মিলিত ব্যর্থতা খুনিদের উল্লাস নৃত্য দেখতে বাধ্য করেছিল গোটা জাতিকে।
১৯৮১ সালের বৃষ্টিস্নাত ১৭ মে শেখ হাসিনাকে বরণ করার জন্য জনতার ঢল নেমেছিল। যারা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হারিয়ে দুফোঁটা চোখের জল ফেলতে পারেননি, তারা ১৭ মে অকাতরে চোখের জল ঢেলে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন যেন। শেখ হাসিনার দেশে ফেরার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও তাৎক্ষণিকভাবেই তৈরি হয়েছিল পরিবর্তনের অভিঘাত। মুক্তিযুদ্ধের হারানো চেতনাকে ফিরিয়ে আনার রাজনীতি বলবান হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল।
শেখ হাসিনা বাবার মতো রাজনীতিতে সাফল্য দেখাতে পারবেন কি না তা নিয়ে শুরুতে কারো কারো মধ্যে সংশয় ছিল। রাজনীতি থেকে যিনি নিজেকে পিতার ইচ্ছায় দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন, তিনি পিতার রাজনীতির ধারা এগিয়ে নিতে পারবেন কি না সে প্রশ্নও ছিল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই শেখ হাসিনা প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, তার ধমনীতে শেখ মুজিবের রক্ত বহমান, তাই তিনি পরাজয় মানতে জানেন না।
যারা ভেবেছিলেন বাংলাদেশে মুজিব হত্যার বিচার হবে না, আওয়ামী লীগ আর কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারীদের বিচার হওয়া সম্ভব নয়, তাদের ভুল প্রমাণ করেছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে আজ সবাই পরাজিত হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু যেমন তার সময়ের অন্যসব রাজনীতিকদের ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন, শেখ হাসিনাও তেমনি তার সময়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। কাজটি অবশ্যই সহজ ছিল না। ঘরে-বাইরে বৈরিতা ছিল এবং আছে। সব মোকাবিলা করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার এক বিরল কৃতিত্বের অধিকারী এখন শেখ হাসিনার।
শেখ হাসিনা একটি কথা প্রায়ই বলে থাকেন— ‘আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, শিশু ছোটভাই রাসেলসহ আপনজনদের হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাঁদের ফিরে পেতে চাই।’
মানুষের প্রতি তার মমত্ববোধ আর ভালোবাসার কারণে আজ পৃথিবীতে বাংলাদেশ একটি কার্যকর কল্যাণমুখী রাষ্ট্র। শেখ হাসিনা সরকার-প্রবর্তিত সামাজিক সুরক্ষা বলয় গোটা উন্নয়নশীল বিশ্বে এক অনন্য ঘটনা। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে লাখ লাখ গৃহহীন, ঠিকানাহীন মানুষের জন্য নতুন জীবনের সন্ধান দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তার সুদক্ষ, সাহসী নেতৃত্ব ও সফল কূটনৈতিক তৎপরতায় মিয়ানমার ও ভারতের কাছ থেকে বিশাল সমুদ্রসীমা জয় করেছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সমুদ্র-আইন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর খুব কম দেশই এত সফলভাবে সমুদ্রের ওপর তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।
পাকিস্তানের ২৪ বছরে, জিয়া-এরশাদ ও খালেদা জিয়ার মোট ৩১ বছর শাসনামলে যেখানে ভারতের সঙ্গে স্থল সীমান্ত সমস্যার সমাধান হয়নি, সেখানে তার কার্যকর কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারত গ্রহণ করেছে, যার মোট আয়তন ৭ হাজার ১১০ একর ভূমি।
অপরদিকে, ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশ পেয়েছে, যার মোট আয়তন ১৭ হাজার ১৬০ একর ভূমি। ফলে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে ১০ হাজার ৫০ একর বা ৪০.৬৭ বর্গকিলোমিটার ভূমি পেয়েছে।
একটি স্বল্পোন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও ১৩ হাজার ৫ শয়ের মতো কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আরও ৪ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণাধীন (ইতিমধ্যে অনেকগুলো শেষের দিকে)। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তার নেতৃত্বে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র দিনরাত কাজ করেছে। দেশের কৃষক-শ্রমিক, দিনমজুর, খেটে খাওয়া তথা স্বল্প আয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। মানুষকে বাঁচাতে ও অর্থনীতিকে রক্ষা করতে লাখ লাখ কোটি টাকার অনুদান ও প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে, যা খুব প্রশংসনীয়।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন তার আরেকটি সাহসী সিদ্ধান্ত। যা বাঙালিকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। চলতি বছর অক্টোবর মাসেই সেতুতে রেল চলাচলের শুভ উদ্ভোদন করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এতে দক্ষিণ বঙ্গের সঙ্গে শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থাই সহজ হবে না, অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে ঢাকায় মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চলমান এবং খুব শীগ্রই শুভ উদ্ভোদন হতে যাচ্ছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে করা বঙ্গবন্ধু টানেল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেকগুলো নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন শেখ হাসিনা। রাজনীতিবিদরা সাধারণ ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিতে অভ্যস্ত। ক্ষমতার বাইরে থেকে যা বলেন, ক্ষমতায় গিয়ে তা করেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা এখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি যা বলেন, তা করেন। চাপ দিয়ে, আন্দোলনের নামে সহিংসতা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে নমনীয় করা যায়নি, যায় না।
তিনি যেটা সঠিক মনে করেন, সেটা বাস্তবায়িত করার জন্য যে যে পদক্ষেপ নেয়া দরকার তিনি তা নিতে পিছপা হন না। তবে তাকে কখনও কখনও কৌশলী হতে হয়, সময় ও সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তাতে কারো কারো মধ্যে সংশয়ও হয়তো তৈরি হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত শেখ হাসিনা তার নিজের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দৃঢ়তা দেখাতে ভুল করেন না। তার গৃহীত পদক্ষেপ সবাইকে নিশ্চয়ই খুশি করে না। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত সমাজে রাজনীতিতে একমত একপথ হয়ে চলা সহজ নয়। তবে শেখ হাসিনার হাত ধরে রাজনীতিতে অস্থিরতা অনেকটাই দূর হয়েছে। শেখ হাসিনাকে যদি সময় ও সুযোগ দেয়া যায় তাহলে তিনি সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন।
তিনি পরপর তিনবার দলকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করে তার রাজনৈতিক কৌশলের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন। রাজনীতি মূলত নীতি ও কৌশলের খেলা। কৌশলে তিনি শতভাগ জিতেছেন। তবে দেশে নীতিহীনতার রাজনীতি প্রকট হয়ে উঠেছে। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। রাজনীতি পরিণত হয়েছে কেনাবেচার পণ্যে। রাজনীতির ব্যবসা অনেকের ভাগ্য বদলে সহায়ক হয়েছে। এটা দুঃখজনক। রাজনীতি নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব অনেকের মধ্যেই প্রবল। নষ্ট রাজনীতি নিয়ে হতাশাও ব্যাপক। সেজন্য এখন ক্ষমতার রাজনীতির পাশাপাশি নীতির রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার সাফল্য দেখার অপেক্ষায় দেশের মানুষ।
শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অবস্থায় যারা মনে করছেন বাংলাদেশের পরিণতিও শ্রীলঙ্কার মতো হবে, তাদের উল্লাসনৃত্য বন্ধ হতে সময় লাগেনি ইনশাআল্লাহ লাগবেও না । তবে হ্যাঁ, শেখ হাসিনা নিঃসঙ্গ শেরপার মতো একাই বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে চলছেন। তার সঙ্গে একদল বিশ্বস্ত নির্লোভ সহযোদ্ধা এখন খুব বেশি প্রয়োজন। পাবেন কি তেমন নিবেদিতপ্রাণ আদর্শের লড়াইয়ে শামিল হওয়ার মতো যোদ্ধা দল?