মাহমুদুল হাসান
এখানে কুরআনের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে ঈমানের বিভিন্ন রুপ রয়েছে যেগুলো শুনে বিশ্বাস করতে হয়। প্রথমত, আমরা জানবো ঈমানের কিছু ফল আছে সে সম্পর্কে। আপনি কিভাবে জানবেন যে, আপনার ঈমানের স্বাদ কেমন লাগতে পারে? মূলত ঈমানের ফল হচ্ছে প্রশান্তি অনুভব করা। প্রশান্ত অন্তর।
আমরা জেনেছি মানুষ ক্ষতির মধ্যে ডুবে আছে। মানুষের কী কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে? স্বাস্থ্যের ক্ষতি। সম্পদের ক্ষতি। প্রিয়জনকে হারানোর ক্ষতি। মানুষ দুনিয়ায় এই জাতীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কিন্তু আপনার যদি ঈমান থাকে, তখন আপনি বিশ্বাস করেন এই দুনিয়াটা চিরস্থায়ী কিছু নয়। দুনিয়াটা ক্ষণস্থায়ী। আল্লাহ আখিরাতে যা রেখেছেন তার তুলনায় এই দুনিয়াটা কিছুই না।
وَمَآ أُوتِيتُم مِّن شَىْءٍ فَمَتٰعُ الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا وَزِينَتُهَا ۚ وَمَا عِندَ اللَّهِ خَيْرٌ وَأَبْقٰىٓ ۚ أَفَلَا تَعْقِلُونَ
﴾তোমাদেরকে যা দেওয়া হয়েছে তা তো কেবল পার্থিব জীবনের ভোগ আর শোভা। অথচ আল্লাহর কাছে যা আছে তা আরো উত্তম ও স্থায়ী। তবু কি তোমরা বুঝবে না? ﴿[সূরা আল-কাসাস : ৬০]
তিনি বলেন, এই দুনিয়ায় কী এমন আছে, আখিরাতের তুলনায় এর কার্যকারিতা কতটুকু? খুবই সামান্য। আপনি যদি সত্যি সত্যিই সেটা বিশ্বাস করেন, আপনার যদি এতে ঈমান থাকে, আপনাকে যাই দেয়া হোক না কেন সেটা দুনিয়াবী জিনিস।
এই আয়াতটিতে আল্লাহ বলছেন না ‘তোমার যা আছে’। তিনি বরং বলছেন ‘তোমাকে যা দেয়া হয়েছে’ (وَمَآ أُوتِيتُم)। আপনাকে যখন কোনো কিছু দেয়া হয়, সেটা আসলে আপনার নিজের নয়। এটা আপনাকে যে দিয়েছে, আসলে তার। সুতরাং, যখন এটা আপনার কাছ থেকে নিয়ে নেয়া হয়, আপনি বলেন, ‘আসলে, এটা তো আমার শুরু থেকেই ছিল না’। কারণ, তিনি আমাকে এটা দিয়েছিলেন। তাঁর এটা নিয়ে নেয়ার অধিকার আছে। যখন আপনার নিজের কিছু হারিয়ে ফেলেন, তখন বলেন, ‘ভাই, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আমি আমার টাকা হারিয়ে ফেলেছি। আমার বাড়ি, আমার গাড়ি, আমার বাচ্চা। আমার স্ত্রী’। কিন্তু যদি আপনি অনুধাবন করতে পারেন এই সবই আপনাকে দেয়া হয়েছিল, এগুলো সবই আপনাকে দেয়া নেয়ামত। তখন এগুলো আপনার কাছ থেকে নেয়া হলেও আমরা কী বলি? আমরা বলি, إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّآ إِلَيْهِ رٰجِعُونَ। ﴾আমরা তো আল্লাহরই (বান্দা) এবং আমরা তাঁরই কাছে ফিরে যাব।﴿ [সূরা বাকারা : ১৫৬] আমরা কিভাবে নিজেদের বলে দাবি করি? যেখানে আমরা নিজেরাই আল্লাহর। আমরা নিজেরাই তাঁর কাছে ফিরে যাব। এভাবে বিশ্বাসীদের মনোভাব পরিবর্তিত হয়।
আমি আপনাদের ঈমানের কেবল ছোট একটি দিক তুলে ধরছি। আমরা বলেছি ঈমানের বেশ কয়েকটি দিক আছে। সামনে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করব। এখানে ঈমানের ফলগুলো নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই। তাহলে ঈমানের প্রথম ফল হচ্ছে প্রশান্তি।
আপনি আপনার স্ত্রীর সাথে প্রশান্তি অনুভব করেন। আপনি গরীব হোন বা ধনী। আপনি অসুস্থ হোন বা স্বাস্থ্যবান। আপনি তরুণ হোন বা বয়ষ্ক। আপনার যদি ঈমান থাকে, আপনার প্রশান্তি থাকবে। আপনি নিজের সাথে প্রশান্তি অনুভব করবেন। আপনি আল্লাহর সাথে প্রশান্তি অনুভব করবেন।
আর বলে রাখি, বেশিরভাগ মানুষই এটা উপভোগ করে না। বেশিরভাগ মানুষই শান্তিতে নেই। এরা শান্তি তাড়া করে বেড়ায়। আপনি কি মনে করেন, মানুষ কেন একটা মুভি দেখে শেষ করে সাথে সাথে আরেকটা নিয়ে বসে? তারা প্রশান্তি পেতে চায়। আনন্দ পেতে চায়, মজা খুঁজে। তাদের অন্তরটা একটু শান্তি পেতে চায়। কেন তারা একটা গাড়ি কিনে আরেকটার পেছনে ছুটে? একটা বাড়ি কিনে আরেকটার পেছনে ছুটে? আমরা এমন করি, কারণ আমাদের অন্তর প্রশান্ত নয়। কিন্তু আল্লাহ বলেন, أَلَا بِذِكْرِ ٱللَّهِ تَطْمَئِنُّ ٱلْقُلُوبُ।
﴾আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমেই অন্তরগুলো প্রশান্ত হয়।﴿ [সূরা রা’দ : ২৮]। এটাই ঈমানের আসল ফল। আর যখন আপনার এটা আছে, আপনার কোনো ক্ষতি নেই। কোনো ক্ষতিই ক্ষতি নয়।
আরেকটা বাস্তব জীবনের উদাহরণ দিচ্ছি।
যে ঘটনাটি বলছি এটা আমার এক বন্ধুর ঘটনা। সে নিউ অরল্যান্ডসে থাকে। আমার এই বন্ধুটির বড় একটা গাড়ির ব্যবসা ছিল। তার দোকানে বেশ দামী গাড়ি ছিল। সে মুসলিম পরিবারের সন্তান। তার এই সকল গাড়ির জন্য সে নগদ টাকা নিত। সে ব্যাংকের ঝামেলায় পড়তে চায়নি। জার্মান গাড়ি। দামি জাপানি গাড়ি। তার দোকানটা পাম গাছে ঘেরা খুব সুন্দর একটা জায়গায় ছিল। প্রতি মাসে সে লক্ষ লক্ষ টাকার গাড়ি বিক্রি করত। ব্যবসা ভালো চলছিল। এরপর ক্যাটরিনা ঝড় এলো। ঝড়ে তার পুরো ব্যবসা পানিতে তলিয়ে গেলো। একটা মাত্র গাড়ি বেঁচে ছিল। সম্ভবত এলএস ৪০০। উন্নত লেক্সাস। আমি যখন তার ও তার বাবার সাথে সাথে দেখা করতে গেলাম, সে সেই লেক্সাসে করে পিজা ডেলিভারি করছিল। এটাই ছিল তার চাকরি।
এখন আপনি ভাবুন, সে কোথা থেকে কোথায় গেল? কেমন ধরনের জীবনযাপন? কেমন ধরনের আর্থিক লেনদেন থেকে কেমন ধরনের জীবনে সে প্রবেশ করলো যেখানে সে পিজ্জা ডেলিভারি করে? কিন্তু তার মুখে বড় একটা হাসি ছিল। আমি তার দিকে তাকালাম, মানুষ এই ধরনের ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়লে তাদের ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া হয় না। তারা আত্মহত্যা করে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। দুমড়েমুচড়ে পড়ে। তারা এটা একেবারেই নিতে পারে না। জিজ্ঞেস করলাম, এটা কিসের হাসি? সে বলল,
যখন ব্যবসা ভালো চলছিল, আমাদের মসজিদে যাওয়ার সময়টুকু ছিল না। আমি আমার বউকে ঠিকমতো দেখতাম না। বাচ্চাদের সাথে দেখা হতো না। এখন সুবহানআল্লাহ, আমরা প্রতি ওয়াক্তের নামাজ মসজিদে পড়ি। থাকার জন্য মাথার উপর ছাদ আছে। প্লেটে খাবার আছে। আমরা কেন অখুশি হবো? আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। আলহামদুলিল্লাহ।
ঈমান থাকলে এটা কোনো ক্ষতি না। এই ধরনের ক্ষতিও কোনো ক্ষতি না। কিন্তু আপনার যদি ঈমান না থাকে, তাহলে এটা একটা ক্ষতি। আপনি পড়ে যাবেন। বাঁচতে চাইবেন না। মানুষ আত্মহত্যা করতে চায়, কারণ সে এই মেয়েকে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু সে তো অন্য একজনকে বিয়ে করেছে। এরপর সে ব্রীজ থেকে লাফ দেয়। সত্যিকারের ঘটনা। নব্বইয়ের দশকে নিউইয়র্কে এরকম একটি ঘটনা ঘটেছিল। একজন এক মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। সে অন্য একজনকে বিয়ে করে। ফলে সে ব্রুকলিন ব্রীজ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। নিজেকে শেষ করে দেয়। খুবই দুঃখজনক ঘটনা। কখন এমনটি ঘটে?
যখন আপনি আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুকে প্রাধান্য দেন। আর আল্লাহকে প্রাধান্য দিলে আপনার অন্তরে প্রশান্তি আসবে। এটা ততক্ষণ আসবে না, যতক্ষণ আপনার ঈমান নেই। ঈমান ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে দিবে। إِلَّا الَّذِينَ ءَامَنُوا, এটাই প্রথম বিষয়;