পুকুর খননের কবলে গোদাগাড়ী, ঐতিহ্য হারাচ্ছে লাল মাটির এই বরেন্দ্রভূমি
রাজশাহী ব্যুরো ঃ রাজশাহীর গোদাগাড়ী একটি ঐতিহ্যবাহি উপজেলা। এই উপজেলাটি বরেন্দ্রভূমির অন্যতম চাষাবাদ উপযোগী অঞ্চল। এলাকাটির মাটি অত্যন্ত লাজুক ও লাল বর্ণের। খড়ায় যেমন শক্ত, তেমনি একটু পানি পড়লেই গলে পায়ে হাঁটার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এই উপজেলার জমিগুলো উঁচু-নিচু হওয়ায় দেখতেও খুব সুন্দর। কিন্তু, ঐতিহ্যবাহি এই উপজেলা দিনে দিনে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এক শ্রেণির মাটি ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য তারা জমির মালিকদের অর্থের লোভ দেখিয়ে, আবার অনেক সময় ভয়-ভীতি দেখিয়ে জমির উপরীভাগের মাটি কেটে নিয়ে ইট ভাটায় বিক্রি করছে। এতে করে একদিকে যেমন নষ্ট হচ্ছে ঐতিহ্য , অন্যদিকে ব্যাপকভাবে ক্ষতি হচ্ছে ফসলী জমির। এ নিয়ে ব্যাপক হুমকির মুখে পড়ছে প্রকৃতি।
শুধু তাই নয়, উত্তোলনকৃত এই মাটি বহন করা হচ্ছে খোলা ট্রলিতে করে। ট্রলি চলার কারণে রাস্তার ক্ষতিসহ মাটি পড়ছে রাস্তায়। স্থানীয় বাসীন্দারা প্রভাবশালীদের এমন কর্মকান্ডে পড়েছে বিশাল দুর্ভোগে। এছাড়াও সামান্য বৃষ্টি কিংবা, কোন কারনে রাস্তায় পানি পড়লে মাটির রাস্তায় ন্যায় কোনভাবেই সে রাস্তায় চলাচল করা যায়না বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন। এমনি অবস্থা রাজশাহী চাপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের পাশে আলিমগঞ্জ এলাকায়। আলিমগঞ্জের ন্যাশনাল পেট্রোল পাম্পের পাশে এমবিএন ইট ভাটার পেছনে ফসলী জমির মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে একটি ইট ভাটায়। নিয়ম করে সকাল ৮ থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় কৃষকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে একটি প্রভাবশালী মহল কৃষকদের ফসলী জমির মাটি কেটে চলছে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে গেলে দেখা যায়, প্রায় ২০ বিঘা জমির মাটি কেটে ড্রাম ট্রাকে করে রাজশাহী মহানগরীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকার রায়পাড়া রেলক্রসিং এর কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। যা বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) আইনের পরিপন্থি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এলাকাটির কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, গোদাগাড়ী উপজেলার ছয়ঘাটিতে অবৈধভাবে ভেকু দিয়ে মাটি কেটে তা আশপাশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছেন একটি প্রভাবশালী মহল । রাত ৯ টার পর থেকে ভোর ৫ টা পর্যন্ত মাটি কেটে ট্রাকে করে রাজশাহী মহানগরীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে, দিনের বেলায় মাটি কাটা বন্ধ রাখা হয়। এলাকাবাসী মাটি কাটার বিষয়টি জানতে পারলেও প্রশাসনের লোকজন কোন অজ্ঞাত কারণে জানতে পারেন না বলে অনেকের সন্দেহ রয়েছে ।
ছয়ঘাটি গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক খান গণমাধ্যমকে বলেন, গত বছরও ঐ স্থানে থেকে মাটি কেটে বিক্রি করা হয়েছিল। গোদাগাড়ী উপজেলা এসিল্যান্ডের হস্তক্ষেপে মাটিকাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু, গোদাগাড়ী এসিল্যান্ড পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার কারনে এবং উপজেলা নির্বাচনের ফাঁকে ২০২৪ সালে এসে রাত থেকে ভোর পর্যন্ত সেখানে নদী থেকে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, বালু ও মাটি কেটে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য করছেন স্থানীয় এক নেতা। যত্রতত্র ও ইচ্ছামতো মাটি-বালু উত্তোলনের ফলে ফসলী জমি বিলিন হচ্ছে। প্রকাশ্যে এসব চললেও নীরব রয়েছে গোদাগাড়ী উপজেলা প্রশাসনসহ পরিবেশ অধিদপ্তর। এদিকে সার্বিক বিষয়ে রাজশাহী গোদাগাড়ীর সহকারী কমিশনার ( ভূমি ) জনাব জাহিদ হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মাটি কাটার অভিযোগ পেয়েছি। এ ব্যাপারে তদন্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শুধু তাই নয় রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে জমির প্রকৃতি পরিবর্তন করে পুকুর খনন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত দুই বছরে অবৈধভাবে ২৪৫টি পুকুর খনন করা হয়েছে। এতে আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে। পাশাপাশি পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। পুকুর খনন থামাতে প্রশাসন অভিযান ও জরিমানাও করছে। জরিমানা পরিশোধের পর আবারও রাতের অন্ধকারে চলছে পুকুর খনন। অথচ, তিন ফসলী জমি নষ্ট করে কোনভাবেই পুকুর খনন, আবাসন ও কলকারখানাসহ অন্যকোন স্থাপনা করা যাবে না বলে আইনও রয়েছে। অথচ, গোদাগাড়ীতে এই নির্দেশনা কেউ মানছেনা। উপজেলার চৈতন্যপুরেও প্রকাশ্যে চলছে পুকুর খনন।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামিম আহমেদ গনমাধ্যমকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কেউ যদি তাঁর নাম করে পুকুর খনন করার কথা বলে থাকেন তবে সাথে সাথে স্থানীয় প্রশাসনকে অবগত করুন। এক্ষেত্রে কাউকে কোন ছাড় দেয়া হবেনা।
রাজশাহী জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্যমতে, ২ বছর আগে গোদাগাড়ী উপজেলায় পুকুরের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৩৮ টি। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২৮৩টিতে। অর্থাৎ, দুই বছরে ২৪৫টি পুকুর খনন করা হয়েছে। তবে স্থানীয় কৃষকদের দাবি, এ সময়ের মধ্যে ৩ শতাধিক পুকুর খনন করা হয়েছে। খনন বন্ধে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ১১ বার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে ১১টি মামলা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে, ৯ জনকে জরিমানা ও ১ জনকে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
পুকুর খনন এবং আবাদী জমির উপরীভাগের মাটি কাটা থেকে বিরত রাখতে এবং দোষিদের শাস্তির দাবী জানান কৃষক, সচেতন মহল ও এলাকাবাসী।